দখিনের খবর ডেস্ক ॥ দেশের প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মানোন্নয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ কর্মসূচি গ্রহন করেছে সরকার। প্রতি বছরের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিয়ে এক নজীর বিহীন অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বর্তমান সরকার। এর পাশাপাশি শ্রেণি কক্ষে বিস্কুট বিতরণ ও শিক্ষার্থীদের স্কুল মুখি করার জন্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে উপবৃত্তির পরিমানও। এমনকি আগামী নতুন বছর থেকে তাদের দেয়া হবে নতুন স্কুল ড্রেস। এত কিছুর পরও কোন সুযোগ সুবিধাই ভোগ করতে পারছে না বরিশাল নগরীর ২২ নম্বর ওয়ার্ডের রুস্তম আলী তালুকদার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দারিদ্র কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। কেননা ওয়ার্ডের একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে দিন দিন শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়লেও পাচ্ছেনা সরকারি কোন সুযোগ সুবিধা। সরকারি সুযোগ সুবিধা পেতে স্কুল কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দিনের পর দিন ধর্ণা দিয়েও কোন কাজ হচ্ছে না। একই সাথে রয়েছে স্কুলের শিক্ষক সংকট। এমনকি শিক্ষক হিসেবে যারা রয়েছেন তারাও পাচ্ছেন না বেতন-ভাতা। মাস শেষে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতার কাছ থেকে পাওয়া নাম মাত্র সম্মানি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাদের। তবে সংকট আর সুযোগ সুবিধার অভাবে দিন দিন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ‘বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ডের প্রায় প্রতিটিতেই রয়েছে একটি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কোন কোন ওয়ার্ডে এর সংখ্যা দুটিও রয়েছে। কিন্তু একমাত্র ২২ নম্বর ওয়ার্ড যেখানে ছিলো না কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়। একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকলেও সেখানে নেই প্রাথমিক স্তর। অথচ শহর থেকে অদূরে বর্ধিত এলাকা নিয়ে গঠিত জনবহুল ২২ নম্বর ওয়ার্ডটিতে রয়েছে অনেক সুবিধাবঞ্চিত এবং দুস্থ পবিবার। যাদের সন্তানদের প্রাথমিক স্তরে শিক্ষায় শিক্ষিত করার শেষ ভরসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
কিন্তু প্রায় ৭হাজার জনসংখ্যার এই ওয়ার্ডটিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোন ব্যবস্থাই নেই। এ কারনে প্রাথমিকের শিক্ষা থেকে বঞ্চিতও হয় অনেক শিশু। এ বিষয়টি মাথায় রেখে স্থানীয় নাগরিকদের দাবি ও সরকারের প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং শিক্ষিত জনগোষ্ঠি গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মানের উদ্যোগ নেন সাবেক কাউন্সিলর মো. শহিদুল ইসলাম তালুকদার। সে অনুযায়ী ২০১২ সালে ওয়ার্ডের কাজীপাড়া আব্দুল আজিজ সড়কে ১১ শতাংশ জমিতে প্রামিক বিদ্যালয় নির্মান করেন তিনি।
টিন সেড এর ওই বিদ্যালয়ে চালু করা হয় প্রাক প্রাথমিক থেকে শুরু করে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান। প্রথমে বছরেই ৩১৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয় বিদ্যালয়টির পথচলা। বছর বছর বাড়তে থাকে স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। মুহুর্তেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে স্কুলটি। কিন্তু সেই জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে স্কুল কর্তৃপক্ষকে। নগরীর কাজিপাড়া এলাকার বাসিন্দা ও স্কুলটিতে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীর দুস্থ অভিভাবক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘২২ নম্বর ওয়ার্ডটিতে একটি স্কুলের দাবী ছিলো দীর্ঘ বছর ধরে। কেননা ওয়ার্ডটিতে কোন সরকারি বা বেসরকারি স্কুল ছিলো না। এমনকি ওয়ার্ডের দু-তিন কিলোমিটারের মধ্যেও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। যাও আছে সেখানে যেতে হলে মহাসড়ক পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। এজন্য ইতিপূর্বে অনেক দুর্ঘটনাও ঘটেছে। তাই নতুন এই স্কুলটির গুরুত্ব অনেক বেশি।
তাজুল ইসলাম নামের অপর এক অভিভাবক বলেন, ‘স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা কম। কিন্তু তার পরেও তারা যেভাবে ছেলে মেয়েদের পাঠদান করছে তা সন্তুষ জনক। তবে সমস্যা হচ্ছে সুযোগ সুবিধার। এ স্কুল থেকে আমাদের সন্তানেরা কোন সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না। যেখানে সরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীরা বছরের শুরুতে নতুন বই, দুপুরের টিফিন (বিস্কুট) এবং উপবৃত্তি পাচ্ছে সেখানে বেসরকারি এ স্কুলে কোন সরকারি সুযোগ সুবিধাই পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রতিষ্ঠানটির মনোন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে স্কুলটিতে সরকারি সুযোগ সুবিধা প্রধান জরুরী বলে মনে করেন ওই অভিভাবক গণ। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, চলতি বছর রুস্তম আলী তালুকদার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন-পুরাতন মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো ৩শত’র বেশি। কিন্তু তা কমে গিয়ে বর্তমানে দাড়িয়েছে ২৬৫ জনে। যার মধ্যে স্কুল থেকে সমাপনি পরীক্ষায় অংশ নিবে ২৩ জন। এছাড়া ৪র্থ শ্রেণিতে ৩৫ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৬০ জন, ২য় শ্রেণিতে ৬৫ জন, প্রথম শ্রেণিতে ৩৮ জন ও প্রাক-প্রাাথমিকের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪২ জন। এরা সবাই ২২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানাগেছে, নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ৩০ জন শিক্ষার্থীর বিপরিতে ১ জন করে শিক্ষক থাকবেন। পাশাপাশি প্রাক-প্রাথমিকের জন্য থাকবে আলাদা শিক্ষকের ব্যবস্থা। কিন্তু স্কুলটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হলেও শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র ৫ জন। যার মধ্যে একজন প্রধান শিক্ষক, একজন সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং বাকি তিনজন সহকারী শিক্ষক। তবে প্রাক-প্রাথমিকের জন্য নেই আলাদা কোন শিক্ষকের ব্যবস্থা।
এব্যাপারে রুস্তম আলী তালুকদার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ফারজানা ববি পাপড়ি বলেন, ‘আমাদের সন্তানেরা যেখানে ভালো নেই, সেখানে আমাদের শিক্ষকদের ভালো থাকার সুযোগ কোথায়। নানা সংকটের মধ্যে দিয়ে আমরা প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। একমাত্র বস্তুনিষ্ঠ পাঠদান ছাড়া সরকারি কোন সুযোগ সুবিধাই আমরা শিক্ষার্থীদের দিতে পারছি না। এর ফলে অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে আবার অন্য স্কুলে চলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের স্কুলে যেসব শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করছে তারা সবাই দুস্থ এবং অসহায় পরিবারের সন্তান। যে কারনে তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে বেতন বা পরীক্ষার ফিও আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না।
স্কুলটির সহকারী শিক্ষিকা শিরিন আক্তার জানান,স্কুল শুরুর প্রথম থেকেই আমরা পাঁচ জন শিক্ষক এবং একজন এমএলএসএস’র ভেতন ভাতার বিষয় রয়েছে। প্রথম কয়েকমাস আমাদের সকল শিক্ষকদের জন্য দুই হাজার টাকা করে সম্মানি দেয়া হলেও করোনার আগ থেকেই তাও বন্ধ রয়েছে। যা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা তার নিজের পকেট থেকে দিয়েছিলেন। তিনি আরো বলেন, ‘নানা সংকটের মধ্যেও শিক্ষার্থীদের বিনোদন এবং ক্রীড়া চর্চার জন্য বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। যেখানে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা চলে যাচ্ছে। তাও স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা দিচ্ছেন। মোট কথা স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা না থাকলে এতো দিনে রুস্তম আলী তালুকদার প্রাথমিক বিদ্যালয় কার্যক্রম গুটিয়ে যেত। সুযোগ সুবিধা না থাকার বিষয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘আমাদের স্কুল সরকারি তালিকায় নেই তাই শিক্ষা অফিস থেকে কোন ধরনের সুযোগ সুবিধাও আমাদের দেয়া হচ্ছে না। ৭/৮ মাস পূর্বে একবার সরকারি বিস্কুটের জন্য ডিপিও (উপজেলা শিক্ষা অফিসার) এর নিকট আবেদন করেছিলাম। কিন্তু তিনি নিরুপায় বলে আমাদের ফিরিয়ে নিয়েছেন। সরকারি তালিকাভুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কোন সুযোগ সুবিধা দেয়া যাবে না বলে ডিপিও অফিষ থেকে জানানো হয়। তাছাড়া স্কুলটি জাতীয় করনের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে আমাদের স্কুলের জমির দলিল,শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের তালিকা সহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেয়ে নিয়েছে।
কিন্তু সে বিষয়ে পরবর্তীতে আর কিছু জানানো হয়নি। আদৌ স্কুলটি জাতীয় করণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে কিনা তাও আমাদের অবগত নয়। এদিকে রুস্তম আলী তালুকদার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. শহিদুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘নিজের সার্থে নয়, ওয়ার্ডবাসির দাবীর প্রেক্ষিতে আমি স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। এজন্য কারোর কাছ থেকে কোন ডোনেশনও নেয়া হয়নি। এখনো স্কুলটির পেছনে প্রতি মাসে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। বিশেষ করে মাস শেষে বিদ্যুৎবিল, ৫ জন শিক্ষক এবং একজন এমএলএসএস’র সম্মানি, আপ্যায়ন খরচ বাবদ আরো দেড় হাজার টাকা সহ অনেক খরচ রয়েছে। কিন্তু আয়ের কোন উৎস নেই। কেননা এখানকার শিক্ষার্থীরা নিতান্তই গরিব পরিবারের হওয়ায় তারা পরীক্ষার ফি বা বেতন ভাতা দিতে পারছে না। যে কারনে নিজের পকেট থেকেই সব ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে স্কুলটির ভবিস্যৎ কোথায় গিয়ে দাড়াবে সে বিষয়টি আমার বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, ‘অন্তত অসহায় মানুষ এবং তাদের সন্তানদের লেখা-পড়ার জন্য হলেও এখানে সরকারি সুযোগ সুবিধা প্রদান করা উচিৎ। তাছাড়া সিটি নির্বাচনকালিন সময় বর্তমান সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ নিজে এই স্কুলে এসেছিলেন।
তাই তিনিও জানেন স্কুলটি সম্পর্কে। যে যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসলে রুস্তম আলী তালুকদার প্রাথমিক বিদ্যালয়টি টিকে যাবে। তাই স্কুলটিতে সরকারি সুযোগ সুবিধা প্রদানসহ সকল ক্ষেত্রে বরিশাল সিটি মেয়র, সদর আসনের এমপি, জেলা প্রশাসক
এবং শিক্ষা কর্মকর্তাদের সহযোগিতা চেয়েছেন বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা মো. শহিদুল ইসলাম তালুকদার ও শিক্ষক ও কোমলমতি শিক্ষিতারা।
Leave a Reply